Culture

আজও প্রাসঙ্গিক অংশুমান রায় : সংসার থেকে সমাজ সব কিছুই যেন নিপুন তুলিতে আঁকা

সেদিনের গীতিকার থেকে সুরকার হয়ে গায়করা কৃপণ ছিল না কোন কিছুতেই। জন জীবনে মিশে যেত সব কটা সৃষ্টিতে। যা আজও বয়ে যায় আমাদের মাঝে। তাইতো ওগুলো অমর সৃষ্টি।

টেক সেবী সমাজে আজও বর্তমান অংশুমান রায় , গায়ক ,সুরকার ও গীতিকার। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই অমর শিল্পী অংশুমান রায়।নিজের কাজ শুধু এই দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক যা আজ এক ইতিহাস । ১৯৩৬ সালের ১৯ শে অগাস্ট ঝাড়গ্রাম শহরের বুকেই বাছুরডোবা অঞ্চলে জন্ম হয় অংশুমান রায়ের।ছোটবেলা থেকেই চারিপাশে লালমাটি – শালবন পিয়াল এর পথ ধরে ছুটতে ছুটতে কখন গলায় সুর বেঁধে নিতো কেও তা আন্দাজ করতে পারতো না। মুখে মুখে বোল তৈরিতে পটু ছিলেন এই সনামধন্য শিল্পী। অকুতোভয় মানুষ ছিলেন , রার বঙ্গের প্রতিটি ছাপ বহন করেছেন সারা জীবন ধরে। আর সন্ধ্যে নামলেই মাদলের তালে তালে ঝুমুর, টুসু, ভাদু গান শুনে তিনি বড়ো হয়ে ওঠেন। পরিবারের এক পূর্বপুরুষ বাঁকুড়ার এক জমিদার সভায় সভাগায়ক ছিলেন এবং তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে সেই জমিদার তাঁকে “রায়” উপাধিতে ভূষিত করেন।

সে অর্থে গান ছিল অংশুমানবাবুর রক্তে। ছেলেবেলায় বড়দার উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় এবং তাঁরই হাত ধরে গান শেখার শুরু। সেই সূত্রে বড়দা শঙ্কর রায়কেই তাঁর প্রথম গুরু বলা চলে, যাঁর কাছে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা পান। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর বাবার ঝাড়গ্রামনিবাসী এক বন্ধুর কাছেই রাগপ্রধান সঙ্গীত ও ঠুংরীর তালিম নেন। গানের পাশাপাশি তবলা ও বেহালা বাজানোও তিনি শিখেছিলেন। এছাড়াও ঝাড়গ্রামেরই এক বন্ধুর বাবার কাছ থেকে তিনি বাঁশি ও মাদল বাজানোও শিখেছিলেন।

প্রথা গত শিক্ষার বাইরে অনেক কিছু শিখলেও ৫০ এর দশকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ঝুমুর, ভাদু, টুসু – রাঢ় বাংলার এইসব লোকসঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করেন এবং এর জন্য তিনি দীর্ঘদিন পুরুলিয়ার অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি, পঞ্চকুটের পাহাড়ি অঞ্চলে সেখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে দিন কাটান। এই গবেষণার কারণেই পরের দিকে তাঁর গানে রাঢ় বাংলার লোকগীতির কথা, সুর ও বাদ্যযন্ত্রের প্রভাব দেখা যায়। সেই অর্থে বলা যায় ৫০ এর দশক থেকেই লালমাটির সুর – গান ও লোকজনের কথা তিনি সবার সামনে তুলে ধরতে শুরু করেন। ষাটের দশকে কলকাতায় থাকাকালীন তিনি প্রবীর মজুমদারের কাছে আধুনিক গানের তালিম নেন এবং জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছেও সঙ্গীতশিক্ষা করেন। এই জ্ঞানপ্রকাশবাবুকেই অংশুমান রায় নিজের বিশেষ গুরু বলে মান্য করতেেন।

সঙ্গীতশিক্ষা সম্পূর্ণ করে তিনি গানের জগতে প্রথম পা রাখেন “সাঁঝে ফোটে ঝিঙা ফুল / সকালে মলিন গো ” এই গানের মাধম্যে – এটিই তাঁকে বাংলা গানের সার্বিক শোতৃবৃন্দের সাথে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিল। ১৯৬২ সালে গানটি অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা শাখা থেকে সারা বাংলার মানুষের কাছে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল।

অংশুমান রায় পাকাপাকিভাবে কলকাতা চলে আসেন এবং বাংলা সঙ্গীতের জগতে গায়ক আত্মপ্রকাশ হয়। রেডিও অডিশনে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে আকাশবাণীতে গান গাওয়া শুরু করেন। এত খ্যাতিলাভের পরেও জন্মভূমি লালমাটির দেশের কথা-গান-সেখানকার মাদলের সুর কিন্তু তিনি ভুলে যাননি, বরং সেটাকেই তিনি তাঁর সাধনার মুখ্য উপজীব্য করে তোলেন।

বর্তমানের অনেকেরই অজানা ও র্একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা হল প্রথম মাদল নিয়ে আকাশবাণীর “রম্যগীতি”তে একটি গান গেয়েছিলেন। এই গানটিই একাধারে ঝুমুর গানকে বাংলার লোকগীতির জগতে একটি নতুন ধারা হিসেবে তুলে ধরে এবং অন্যধারে মাদল নামক বাদ্যযন্ত্রটিকে বাংলার সঙ্গীতসমাজের মূলধারার সামনে নিয়ে আসে। বাংলা গানের ইতিহাসের চিরকালীন শিল্পীত্রয়ী: হেমন্ত-শ্যামল-মান্নার উপস্থিতিতেও অংশুমান রায় তৎকালীন বাংলা সঙ্গীতের জগতে একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নেন।

“সাঁঝে ফোটে ঝিঙা ফুল” গানটির বিপুল জনপ্রিয়তার পর হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে পরপর অনেকগুলো গান তাঁর রেকর্ড হয়, যেগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য – “ভাদর আশ্বিন মাসে ভ্রমর বসে কাঁচা বাঁশে”, “দাদা পায়ে পড়ি রে / মেলা থেকে বৌ এনে দে” ইত্যাদি। লোকগীতির পাশাপাশি আধুনিক গানেও যে তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন তার পরিচয় সঙ্গীতপ্রেমীরা পান তাঁর প্রথম বাংলা চলচিত্রের গানের মাধ্যমে – বিখ্যাত “চারমূর্তি” ছবির “ঘচাং ফু তোকে খাবো” এই গানটির মাধ্যমে। শিবদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ও অজয় দাসের সুর দেওয়া এই গানটি তাঁর সঙ্গীতজীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। মাদলের তাল, ঝুমুর, টুসু গানের পাশাপাশি মূলধারার বাংলা সঙ্গীতেও তাঁর পারদর্শিতা প্রকাশ পায় এই গানটির মধ্যে দিয়েই। এই গানের জন্যই তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলার শ্রেষ্ঠ প্লে ব্যাক গায়কের সম্মানে সম্মানিত হন। তবে অংশুমান রায়ের সবচেয়ে আলোড়ন তোলা গান হলো

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে নিয়ে গাওয়া “শোন একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি” গানটি। এক আড্ডাসভায় বসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল এই গানটি রচনা করেন এবং সেদিনই শুধু হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানটি গান অংশুমানবাবু। আকাশবাণীর “সংবাদবিচিত্রা”র দায়িত্বপ্রাপ্ত উপেন দরফদার সেই আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিই তাঁর টেপ রেকর্ডারে গানটি রেকর্ড করেন এবং সেই রাত্রেই গানটি “সংবাদবিচিত্রা”য় সম্প্রচারিত হয়।

সারা বাংলা জুড়ে আলোড়ন পড়ে যায় এবং তখনকার মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতেও দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে অংশুমানবাবুর নাম। রাঢ় বাংলার লোকগীতি, আধুনিক বাংলা গান বা রবীন্দ্রসঙ্গীত পেরিয়ে তিনি গাইলেন এমন একটি গান যা দুই বাংলার ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়ে গেলো। এই গানটির জন্য ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান নিজে অংশুমান রায়কে সরকারিভাবে বাংলাদেশ থেকে “বঙ্গবন্ধু গোল্ড মেডেল” দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: আমন্ত্রণপত্র হাতে নিয়েও তিনি বাংলাদেশ যেতে পারেননি, কারণ তাঁর কিছুদিনের মধ্যেই আততায়ীর হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। এই গানটি সেই সময় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এখনো বাংলাদেশে গানটিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয় এবং প্রতিটি সরকারী অনুষ্ঠানে বাজানো হয়। এই গানটির জন্যই ২০১২ সালে তাঁকে “মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মান ও মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধা সম্মান” দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে।

তাঁর সঙ্গীতসাধনার জীবনে অসংখ্য সাফল্য এবং খ্যাতি পাওয়ার পেছনে একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে এসেছিলেন তাঁর স্ত্রী শ্রীমতি কমলা রায়। তিনিও আমাদের ঝাড়গ্রাম শহরেরই বাসিন্দা ছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার টান এতটাই ছিল যে ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর মৃত্যুর পর অংশুমানবাবু গভীর মানসিক অবসাদের মধ্যে চলে যান এবং সেই বছরই এপ্রিল মাসে স্ত্রীর মৃত্যুর দেড় মাসের মাথায় তিনি নিজেও মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান। এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে এত গভীর প্রেমের দৃষ্টান্ত বোধহয় আমরা কল্পনাও করতে পারিনা!!

বাংলার সঙ্গীত জগতের ইতিহাসে অংশুমান রায় একটু সমুজ্জল নাম – আমাদের লালমাটির দেশের ঝুমুরকে তিনি সমস্ত বাংলার মানুষের কাছে একটি স্বতন্ত্র লোকগীতির ধারা হিসেবে যেমন পরিচিতি দিয়েছেন তেমনি তাঁর হাত ধরেই আমাদের ঝাড়গ্রাম শহর, তার মাদল-বাঁশির সুর পরিচিত হয়েছে সারা বাংলা জুড়ে। ৬০ এর দশকে ঝাড়গ্রাম ও ঝাড়গ্রামবাসী আদিবাসীদের লোকগীতির সম্পর্কে কলকাতা বা বাংলার অন্যান্য জায়গার লোকেরা প্রায় তেমন কিছুই জানতেন না, অংশুমানবাবুর সঙ্গীতের মাধ্যমেই তা সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে সরকারী তরফ থেকে উপযুক্ত সম্মান ও স্বীকৃতির অভাবে তাঁর নাম আজ মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। নতুন প্রজন্মের গায়কদের অনেকেই তাঁর গান এখনো গেয়ে থাকেন, কিন্তু তাঁদেরও অনেকেই এখনো জানেনই না যে অংশুমান রায় কে ছিলেন বা বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে তাঁর কি অবদান। তাই আসুন আজ আমরা আপনারা সবাই মিলে তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও পরিচিতি প্রদানের চেষ্টা করি এবং সরকারবাহাদুরের কাছেও আমাদের এই আবেদন রইলো যে – কোন সঙ্গীতসম্মান তাঁর নামে চালু করে বা ঝাড়গ্রামের কোন একটি রাস্তাকে তাঁর নামাঙ্কিত করে তাঁকে উপযুক্ত সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা করা হোক!

ওপিনিয়ন টাইমস ওপরের লেখা টি সংগ্রহ করেছে “চেনা অচেনা ঝাড়গ্রাম-jhargram-শালফুল, লালমাটি ” ফেস বুক পেজ থেকে। কিছু জায়গায় শুধু সংযোজিত করা হল। আমরা বেশ কিছু দিন ধরে দুই বাংলার কিছু সোনার সন্তানদের খুঁজে বার করার মরিয়া চেষ্টা করেছি যারা বাংলা ও বাঙালি কে অনেক আগেই বিশ্বের দরবারে প্রিতিষ্ঠিত করেছেন প্রচারের আড়ালে অনেক আগেই । কোন সরকার এদের জন্য কিছু করেন নি , বাংলার গান প্রিয় মানুষ হিসেবে আমরাও অভিমানী ও সমগ্র বাংলার সনস্কৃতি প্রায় মানুষ স্তম্ভিত এই গুণী শিল্পীর কে কোন সন্মান দিয়েছে না এর সৃষ্টি নিয়ে কোন গবেষণাগার তৈরী করা হয়েছে। এই কালজয়ী শিল্পীর সমন্ধে আরো কিছু অজানা তথ্য থাকলে আমাদের জনাবেনা। আমরা নাম তা প্রকাশ করবো, যাতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারে এই ধরণের কৃতি মানুষ কে।আজ অংশুমান রায় , গায়ক ,সুরকার ও গীতিকার এই কৃতি মানুষটির জন্ম দিনে ওপিনিয়ন টাইমস এর শ্রদ্ধার্ঘ্য। (কৃতজ্ঞতা শিকার : Hindusthan Record Bengali কভার ছবি ও রেকর্ড )

Show More

OpinionTimes

Bangla news online portal.

Related Articles

Back to top button

Discover more from Opinion Times - Bengali News

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading